হজ মুসলিম ঐক্যের প্রতীক

Saiful Islam

নিউজটি অন্যদের সাথে শেয়ার করুনঃ

print news

সাইফুল ইসলাম চৌধুরী:- মুসলিম বিশ্বের সর্ববৃহৎ মহা-সম্মেলনের নাম হজ। পবিত্র কাবাগৃহকে কেন্দ্র করে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে বিশ্বের সুদূর প্রান্তসমূহ হতে সামর্থ্যবান মুসলমানগণ অন্তরভরা ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আবেগজড়িত চিত্তে মক্কায় হাজির হন এবং সম্পাদন করেন হজের যাবতীয় কার্যাবলী। মূলত হজ মুসলিম জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ঐক্য ও পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব এবং মমত্ববোধের এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। হজ শব্দটি আরবি। অর্থ- ইচ্ছা ও সংকল্প করা, সাক্ষাৎ করা।

হজের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো- To make decision, To meet. মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কার্যাবলীর মাধ্যমে সম্মানিত বায়তুল্লাহ যেয়ারতের সংকল্প করার নামই হজ। হজের মধ্যে মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতির জন্য ইহকালীন এবং পরকালীন জীবনে বিবিধ কল্যাণ রেখেছেন। ঘটিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের ইবাদাতের সমাবেশ। পবিত্র বাইতুল্লাহথর দর্শন, তাওয়াফ, মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ আদায়, দাঁড়িয়ে ঝমঝমের পানি পান, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে প্রদক্ষিণ, মিনায় অবস্থান ও নামাজ আদায়, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, হজের খুতবা শ্রবণ, প্রাণ খুলে দোয়া, রাতে মুযদালিফায় অবস্থান, মিনায় কংকর নিক্ষেপ ও রাত্রিযাপন, তথায় পশু কুরবানী ও মাথা মুন্ডানোসহ আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে জন্য বেশি বেশি জিকির ও তাঁর দিকে ধাবিত হওয়াকে হজের অনুষঙ্গ করলেও হজের মাধ্যমে আরেকটি বে-মেসাল কল্যাণ ভোগ করেন মুসলিম বিশ্ব। আর তা হলো ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্য। হজে উঁচু-নিচু, কালো-সাদা ভেদাভেদহীন মিলনমেলায় যে অসাধারণ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি হয় তা আর কোন উপলক্ষে হয় বলে আমার জ্ঞানে নেই। মুসলিম ঐক্যের সূতিকাগার কাবাঘরে সর্বপ্রথম হজ আদায়কারী হযরত আদম (আঃ)। তারপর নূহ (আঃ)-সহ অন্য অন্যান্য নবী-রাসূল যথাক্রমে এই দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)’র সময় থেকেই হজ ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে বান্দার জন্য নির্ধারিত হয়।

হিজরি সনের ১২তম মাস হলো জিলহজ্জ মাস। পাক কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী এই সময়ই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-কে হজের ঘোষণা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। স্রষ্টা থেকে আদিষ্টিত হয়ে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আবু কোবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে অঙ্গুল রেখে ডানে-বামে এবং পূর্ব-পশ্চিমে মুখ ফিরিয়ে ঘোষণা করেছিলেন: হে মানব সকল! তোমাদের পালনকর্তা নিজের গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের ওপর এই গৃহের হজ্ব ফরজ করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন করো”। এই বর্ণনায় আরো উল্লেখ আছে যে ইব্রাহিম (আঃ)থর ঘোষণা প্রভুর পক্ষ থেকে বিশ্বের সবখানে পৌঁছে দেয়া হয়েছিল। সুবহানাল্লাহ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীল কাজ ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে। (বুখারি ও মুসলিম) অন্যদিকে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেন, তোমরা হজ ও উমরাহ সঙ্গে সঙ্গে কর, কেননা এ দু’টি দারিদ্র্য ও গুনাহ এমনভাবে দূর করে, যেভাবে হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে। আর মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়। (ইবনে মাজাহ) হাজিরা হলেন মহান আল্লাহর মেহমান। মেহমানের চাহিদা পূরণ করা, মেহমানের দোয়া কবুল করা মেজবানের কর্তব্য। হাদিস শরিফে হাজিদের আল্লাহর প্রতিনিধি দল বলা হয়েছে এবং তাদের দোয়া কবুল ও মাগফিরাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হজ ও উমরাহকারীরা হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা যদি তাঁর কাছে প্রার্থনা করে তিনি তা কবুল করেন আর তারা যদি তাঁর কাছে ক্ষমা চান তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ) হজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, হজ করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন এবং হাজিরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ লাভ করে। বান্দারা হজের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করতে পারে। আর তা হলো জান্নাত লাভের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। যেমন হাদিসে এসেছে, হজে মাবরুর তথা মকবুল হজের প্রতিদান হলো একমাত্র জান্নাত। (তারিখুল কবির) সাধারণত ইবাদত তিন প্রকার। যথা- ১. ইবাদতে বদনি তথা দৈহিক ইবাদত যেমন সালাত, রোজা। ২. ইবাদতে মালি তথা আর্থিক ইবাদত যেমন জাকাত। ৩. ইবাদতে মুশতারিকাহ তথা দৈহিক ও আর্থিক উভয়ের সমষ্টি যেমন হজ। হজে শরীরের সুস্থতা যেমন প্রয়োজন তেমনি আর্থিক সচ্ছলতারও প্রয়োজন। সুতরাং হজের মধ্যে দৈহিক ও আর্থিক উভয় প্রকারের ইবাদত বিদ্যমান। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মানুষ (সকল)! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিতি লাভ করতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাবান যে অধিক মুত্তাকি। আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সকল বিষয়ের খবরাখবর রাখেন। (সুরা আল-হিজরাত) এ আয়াতের মর্মার্থ থেকেই হজ প্রবর্তনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়।

বিশ্বের দূর-দূরান্ত থেকে মুসলমানগণ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একই বাবা-মায়ের সন্তানের মতো সর্বাধিক প্রিয়স্থানে (পবিত্র নগরী মক্কায়) একত্রিত হতে আগমন করবে। যেখানে সবার মাঝে পারস্পরিক মিলন ঘটবে, একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হবে। তারা পরস্পর কল্যাণকর ও তাকওয়ার কাজে সহযোগিতার সুযোগ লাভ করবে। তাদের সবার কথা, কাজ ও জিকির আজকার হবে এক ও অভিন্ন। যা নিঃসন্দেহে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন জ্ঞানীরা। ঐক্যের শক্তিশালী মাধ্যম হজের ব্যাপারে মুহাম্মদ আলী বলেন- No other instruction in the world has the wonderful influence of the Hajj in levelling all distinctions of race, colour and rank বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ, সাম্যের বিকাশ সাধন, পারস্পরিক সম্প্রতি সৃষ্টি, পারস্পরিক কল্যাণ কামনা, শৃংখলবোধ জাগ্রতকরণ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি, বিশ্ব সম্মেলন, আন্তর্জাতিক ঐক্য সৃষ্টি, ভাবের আদান প্রদান, মৌলিক অধিকারের প্রতীক, দ্বীন কায়েমের দৃপ্ত শপথ গ্রহণে শক্তিশালী মাধ্যম, আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠা, মতপার্থক্যের অবসান, ভৌগোলিক জ্ঞান অর্জন, সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করাসহ মুসলিম বিশ্বের উন্নতি সাধনের এক মহাসুযোগ হলো পবিত্র হজ। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক লেনারের চোখে হজ্ব- The Whole of humanity assumes one aspect and attitude and thus the noblest sight of equality and brotherhood is witnessed in Hajj. There is in his city a force which transcludes, the littleness and divisions of mankind.

লেখক,কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা:-সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
খতিব: এ কে এম ফজলুল কবির চৌধুরী জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

নিউজটি অন্যদের সাথে শেয়ার করুনঃ