কায়ছার উদ্দীন আল মালেকী: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী ভারতীয় উপমহাদেশের অষ্টাদশ শতাব্দির একজন প্রখ্যাত সূফিসাধক ও বনাঢ্য রাজনীতিবিদ (১৭৯০—১৮৫৮) । ইতিহাসবিদগণ তাঁকে মুসলিম মুজাহিদ ও গাজীয়ে বালাকোট হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন।
তাঁর জন্মস্থান ও জন্মসাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতনৈক্য রয়েছে। অধিকাংশের মতে তিনি ১৭৯০ সালের দিকে নোয়াখালী জেলার ছান্দিনা বা দান্দিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতার নাম মাওলানা শেখ ফানাহ। পিতার হাত ধরেই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। পড়াশুনা শেষ করেন কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বিভিন্ন বইয়ে তাঁকে মুহাদ্দিস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। এমনকি বিভিন্ন ভাষায় তাঁর পান্ডিত্য ছিলো অভূতপূর্ব।
সূফি নিজামপুরী একজন সুপ্রসিদ্ধ শায়খুল হাদীস ছিলেন। তৎকালীন সময়ের হাদীস বিশারদগণের চাল—চলন, আচার—ব্যবহার, উঠা—বসা, কথাবাতার্, খাওয়া—দাওয়া, ধার্মিকতা ও সামাজিকতা ছিলো সুন্নতে নববীর বাস্তব প্রতিফলন। সূফি নিজামপুরীও অনুরূপ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। একদা সূফি নিজামপুরী স্বপ্নে রাসূল (দ.) তাঁকে জানালেন যে, “কলকাতায় আমার ছেলে সৈয়দ আহমদ (রহ.) এসেছে। তুমি তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করো”। সূফি সাহেব অনুরূপে সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর কাছে (তরীক্বত ও জিাহদের) বাইয়াত গ্রহণ করেন। বাইয়াত শব্দটি আরবী ‘বাইয়ুন হতে নির্গত’ যার অর্থ বিক্রয়। অথার্ৎ শরীয়তের অনুসৃত পথে জীবন পরিচালনার জন্য একজন আল্লাহ ওয়ালা জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট ওয়াদাবদ্ধ হওয়া। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা সূরা আল ফাত্হ এর ১০ নং আয়াতে বলেন, “আর যারা আপনার কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে, তারা শুধু আল্লাহরই কাছে বাই‘য়াত গ্রহণ করে; আল্লাহর হাত তাদের হাতের উপর; অতঃপর যে কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলে তার ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম বর্তাবে তারই উপর। আর যে আল্লাহকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করবে অচিরেই আল্লাহ তাকে মহা পুরস্কার দেবেন।”
প্রশ্ন রাখতে পারেন, সূফি নিজামপুরী একজন বড় আলেম হয়েও কেন পীরের (পীর ফারসি শব্দ, অর্থ— জ্ঞানী) হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলেন? বাইয়াত হলো— আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাথে এই মর্মে প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ হওয়া যে, আমি শরীয়তের পরিপন্থী কোন কাজ করবো না। শরীয়ত অনুযায়ী জীযন—যাপন করবো। আর জিহাদের বাইয়াত বলতে, আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখার জন্য যেকোন সময় যেকোন পরিস্থিতিতে নিজের জান—মাল ও সামর্থ্য দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। সৈয়দ আহমদ বেরলভী একজন কামেল মানুষ ছিলেন। যেকোন বান্দাকে তরীক্বতের দীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতেন। প্রত্যক্ষ কারণ হলো, আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন ও মুসলিম বিদ্বেষীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বাইয়াত। পরোক্ষ কারণ হলো, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ।
তিনি তরীক্বতের ছবক গুলো দ্রুত শেষ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে রূহানী সংযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। কিছু সময় পেরিয়ে গেলে হজরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী তাঁকে তরীক্বতের খেলাফত বখশিশ করেন এবং আধ্যাত্মিক পথ সন্ধানীদের তরীক্বদের ছবক ও তাওয়াজ্জুহ প্রদানের অনুমতিও। উল্লেখ্য যে, তখনকার সময়ে সৈয়দ আহমদ বেরলভীর হাতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য অসংখ্য মানুষ ভীড় জমাত! ইতিহাসবিদগণ এ দৃশ্যকে কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের সাথে তুলনা করেছেন। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর পূর্বে ভারতে শিখ ধর্ম অনুসারী এবং ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের আচার অনুষ্ঠান ঠিকমত পালন করতে দিত না! এবং নানান ভাবে মুসলমান এবং সাধারণ জনগণদের উপর অন্যায়ভাবে জুলুম নিযার্তন করতেন। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তোলার জন্য সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভীর একটি শক্তিশালী মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেন।
সে বাহিনীর মধ্যে সূফি নূর মুহাম্মদ ছিলেন রণাঙ্গনের অন্যতম দীপ্তমান মুজাহিদ। ১৮২১—১৮৩১ দশ বছর তিনি সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীর’র সান্নিধ্যে ছিলেন। ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে সাইয়্যিদ বেরলভীর সাথে হজব্রত পালন করেন। অনেকবার মক্কা শরীফ ও মদীনা শরীফ যাওয়ার সুভাগ্য হয়েছিল তাঁর। তৎকালীন সময়ের বড়বড় আলেমগণ শহীদ আহমদ বেরলভী’র মুজাহিদ বাহিনীর কাফেলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তন্মধ্যে, মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী, নোয়াখালীর মাওলানা গাজী ইমামুদ্দীন বাঙ্গালী সাদুল্লাপুরী। তাঁরা সকলেই পীর বেরলভী (রহ.)’র খলিফা ছিলেন।
সূফি নূর মুহাম্মদ ১৮২৬ —১৮৩১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৮টি ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তন্মধ্যে, আকুড়ার যুদ্ধ, নওশাহের যুদ্ধ, পাঞ্জতারের যুদ্ধ, মায়দার যুদ্ধ, শায়দুর যুদ্ধ, হাজারার যুদ্ধ, মাইয়ার যুদ্ধ, ফুলেড়া অভিযান, পেশোয়ার অভিযান ও ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ। মায়দার যুদ্ধে শত্রুপক্ষ; কামানের গোলা ছুঁড়তে শুরু করলে যুদ্ধে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে! এমতাবস্থায় সূফী নূর মুহাম্মদ হাকীকতে মাকামে সাইফুল্লাহ’র ফয়েজ প্রয়োগ করেন; ফলে নিজেদের সৈন্য রক্ষা ও শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার প্রথম পদক্ষেপে সফল হন। এমনকি নিজ হাতে দিয়ে কামানের গোলা হস্তগত করে অকার্যকর করে দিতেন! এ যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনী জয়লাভ করে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, কামান, গোলা, বারুদ হস্তগত করেন।
উল্লেখ্য যে, ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের মাইয়ার যুদ্ধে মাওলানা আব্দুল হাকীম বাঙ্গালী ও সূফী নূর মুহাম্মাদ নিজামপুরী (রহ.) প্রমুখ আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং ফজলুর রহমান বর্ধমানী শহীদ হন।
নওশাহের যুদ্ধে সূফী নূর মুহাম্মদ সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অসীম বীরত্ব ও যুদ্ধের রণকৌশলের কারণে প্রতিপক্ষের সহস্রাধিক সৈন্যের মোকাবেলা করেন এবং সর্বোপরি এ যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হন। এ সকল যুদ্ধে সূফি নূর মুহাম্মদ যুদ্ধের পূর্বে সেনা বাহিনীর চতুর্দিকে একটি রুমাল ঘুরিয়ে প্রদক্ষিণ করতেন এবং শত্রুপক্ষের তীর, বর্শা ইত্যাদি বিসমিল্লাহ বলে হাত দিয়ে ধরে ফেলতেন! অগণিত তীর, বর্শা ও বল্লমের আঘাতে তাঁর একহাত অবশ হলেও; যুদ্ধের রণক্ষেত্র থেকে পিছপা হননি।
এক যুদ্ধের প্রাক্কালে পীর বেরলভী তাঁর মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে রণজিৎ সিং এর প্রাসাদের অদূরে তাবু স্থাপন করেন। নামাযের সময় ঘনিয়ে আসলে, পীর বেরলভী ঘোষণা দেন যে, “আজ ঐ ব্যক্তি আযান দিবেন যার (দীর্ঘ সময় উল্লেখপূর্বক) আসরের সুন্নাত নামায ছুটে যায়নি।” সেদিন সূফী নূর মুহাম্মদ আযান দেন। বর্ণনায় এসেছে যে, তাঁর আযানের সাথে সাথেই রণজিৎ সিং এর রাজমুকুট খসে পড়ে এবং ঝড় শুরু হয়।
ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ ১২৪৬ হিজরীর ২৪ জিলকদ জুমাবার ৬ ই মে ১৮৩১ ইং সালে বালাকোট প্রান্তরে সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধকে ঐতিহাসিকগণ দ্বিতীয় কারবালা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ যুদ্ধে সূফী নূর মুহাম্মদ’র ভূমিকা ছিলো অবর্ণনীয়। এ যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদ ছিলো ৩০০ জন এবং শিখদের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। শিখরা ছিলো অস্ত্রশস্ত্র ও রশদে সজ্জিত। মুজাহিদদের অসাধারণ রণকৌশল ও বীরদর্পে যুদ্ধের কারণে ২০ হাজার শিখ সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র হতে পিছপা হয়ে প্রায় ছয় মাইল দূরে সরে যায়। কিছুকিছু বিশ্বাসঘাতক “পাঠান” এর কারণে অতর্কিত আক্রমণের কারণে মুসলিম যুদ্ধারা বিপর্যয়ে পড়ে যায় এবং আমিরুল মুজাহিদিন,আওলাদে রাসূল (দ.), তরীক্বায়ে মুহাম্মাদির প্রবর্তক, আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র, হজরত সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী ও তাঁর খলিফা নায়েবুল মুজাহিদিন হজরত শাহ্ ইসমাইল (রহ.) ও সাইয়্যিদ ওয়ারেস আলী সহ অনেকেই প্রমুখ শাহাদাতের শুধা পান করেন। এজন্য কবি বলেছেন,মহা—বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন—রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ—ভূমে রণিবে না বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।
এমন সঙ্কট মুহূর্তে সূফী নূর মুহাম্মদ সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুজাহিদের উদ্দেশ্যে একটি ঈমানদীপ্ত ও জাগরণী ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণে মুজাহিদ বাহিনী মনোবল ফিরে পান। দুর্বারগতিতে আবারও যুদ্ধ শুরু করলেন। সূফি নূর মুহাম্মদ একাই প্রায় দুই হাজার শিখকে হতাহত করেন। তাঁর হাঁটুর একপাশে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে হাঁটুর অন্য পাশে বের হয়ে যায়! কিন্তু তাঁর কোন অনুভূতিই ছিলো না, হাঁটু দিয়ে অঝোর ধারায় রক্ত প্রবাহিত হয়ে কাপড় রঞ্জিত হলে আঘাতের অনুভব হয়। অনাহারে বিরামহীনভাবে যুদ্ধ করায় ক্রমশঃ দুর্বল হলেও যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাননি। এক পর্যায়ে সারা শরীরে জখম হয়ে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকলে তিনি তরবারি ছেড়ে দিয়ে কবিতাংশ আবৃত্তি করে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানান, “বরছুরম আমদওলে বিছিয়ার জোদ আজমন গুনদাসত, দৌলাত তেজী কেমীন গৌইয়ান্দ শমশির তাবুয়াদ।” অর্থাৎ “হে আমার রব! আমার মাথার উপর অনেক তীর তরবারি এসে পড়েছে কিন্তু তাতে আমার কোনো খবরই ছিল না বরং তরবারি আমাকে ঐশী প্রেরণা দেয় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। কিন্তু আমি যে হীন দুর্বল হয়ে পড়েছি।
আর যুদ্ধ করতে পারছি না।” বালাকোট যুদ্ধে এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ‘গাজীয়ে বালাকোট’ খেতাব প্রাপ্ত হন। বস্তুতঃ ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারাবালা কি বাদ। অর্থাৎ ইসলাম জিন্দা হয় প্রতিটি কারবালার পরে। হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, কোনো কুরবানিই বৃথা যায় না। অনুরূপে হজরত সাইয়্যিদ শহীদ আহমদ বেরলভী (রহ.) সহ অসংখ্য মুজাহিদ প্রাণ দিয়ে এ উপমহাদেশে ইসলাম কে পুনর্জীবিত করেছেন এবং উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের মহাজাগরণ সৃষ্টি করেছেন। এজন্য কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,
“অসত্যের কাছে কভু নত নাহি হবে শির,
ভয়ে কাপে কাপুরুষ লড়ে যায় বীর” ।
এ মহান সংগ্রামী সাধক পুরুষগণ চাইলে, মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা ও পীর—মুরিদী ব্যবস্থা নিয়ে আমোদ প্রমোদে জীবনযাপন করতে পারতেন। তাঁরা জীবন দিয়েছেন তবু ঈমান দেননি। তাঁদের এক হাতে ছিলো তসবিহ আরেক হাতে ছিলো রাঙ্গা তলোয়ার এবং মুখে ছিলো আল্লাহর জিকির এটি ছিলো তাঁদের জীবনদর্শন।
তিনি সুন্নাত মোতাবেক জীবন—যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তন্মধ্যে, অসুস্থ রোগীদের দেখাশুনা ও সেবা—শুশ্রম্নষা করতেন এবং মৃতব্যক্তির নামাজে জানাজায় শরীক হতেন। স্বতঃস্ফূতভাবে অন্যের কাজ করে দিতেন । গরীবও দুঃখী মানুষের পাশে থাকতেন। নীরবে নিভৃতে অকাতরে মানুষকে দান করতেন। চলায়—ফেরায় বিলাসিতা পরিহার করতেন। মিতভাষী, মিষ্টিভাষী ও নম্রভাষী হয়ে সকলের সাথে বিনয়ী আচরণ করতেন। বিপদে, সংগ্রামে ও সংকটে আস্থা ও ভরসা রাখতেন এক আল্লাহর উপর; যিনি বিপদমুক্তকারী ও সাহায্যকারী।
ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক সাধারণ জীবনযাপন করতেন। হালাল উপার্জন ছাড়া আহার করতেন না। সন্দিহান বিষয় হতে নিজকে বিরত রাখতেন। আল্লাহর জিকির ও দরুদে মোস্তফায় অবিশ্রান্ত থাকতো তাঁর জবান ও ক্বলব। এক ওয়াক্ত নামাজ শেষে অন্য ওয়াক্ত নামাজের জন্য অপেক্ষমাণ থাকতেন। সালাতুল ফজর আদায় করে সালাতুল ইশরাক পর্যন্ত জিকিরুল্লাহ ও মুরাক্বাবার হালতে নিমগ্ন থাকতেন। সালাতুল জোহর থেকে সালাতুল আসর পর্যন্ত হাদিস ও ইলমে তাসাউফের কিতাবাদি অধ্যায়ন করতেন এবং সালাতুল এশার পর তরীক্বতের অজীফা ও মুরাক্বাবা—মুশাহাদার অনুশীলন করতেন।
তিনি ছিলেন যুগের খালেদ বিন ওয়ালিদ। তাঁর কাছ থেকে অগণিত কারামাত প্রকাশিত হয়েছে। যা অবর্ণনীয় ও অলেখনীয়। একটি বর্ণনায় এসেছে যে, ইংরেজ সৈনিকরা তাঁকে গ্রেপ্তার ও প্রাণনাশ করার জন্য বহুবার বহুজায়গায় চারিদিকে ঘিরে রেখে ছিলেন। অথচ সেখান হতে তৎক্ষনাৎ অদৃশ্য হয়ে যেতেন। এটি ছিলো তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি প্রয়োগের ক্ষুদ্রাংশ বিশেষ “কারামাত”। সূফি নূর মুহাম্মদ (রহ)’র উল্লেখ্য যোগ্য খলিফাগণের মধ্যে, সূফী সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (রহ.) অন্যতম। আর এ বরহক্ব সিলসিলার ক্রমধারা প্রাচ্য হতে পাশ্চাত্য ছড়িয়ে গেছে। এ তরীক্বার শাখা মধে, ফুরফুরা দরবার শরীফের, ফুলতলী দরবার শরীফ, ছারছিনা দরবার শরীফ, সোনাকান্দা দারুল হুদা দরবার শরীফ, খাজা বাবা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী দরবার শরীফ, শামসুল ওলামা সূফি গোলাম সালমানী আব্বাসী, সাইয়্যিদ আবদুল বারী শাহ্, হজরত হাফেজ হামেদ হাছান আজমগড়ী, হাফিজ মুনিরুদ্দীন নুরুল্লাহ, গারাংগিয়া দরবার শরীফ (সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম), কুতুব শরীফ দরবার (কুতুবদিয়া,কক্সবাজার), কাগতিয়া দরবার শরীফ (রাউজান, চট্টগ্রাম) সহ অসংখ্য অগণিত তরীক্বতের জংশনে বিস্তৃত। যাদের পরশে হাজারো বিপদগামী মানুষ সত্যের পথের সন্ধান পেয়েছেন এবং যাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে, হাজারো মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, এতিমখানা, মক্তব মেডিকেল, স্কুল—কলেজ, বিশ্ববিদালয় সহ অসংখ্য দাতব্য ও প্রশিক্ষণ মূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
তিনি পীর—মুরিদী ও মাজার কেন্দ্রীক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়াামির ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। ইন্তেকালের পূর্বে একটি অছিয়ত নামা লিখে যান। যেখানে লেখা ছিলো, “আমার কবরের উপর ঘর বা গম্বুজ করিওনা। আমার কবর নিয়ে অযথা ব্যয় করিও না। আমার কবরকে কেন্দ্র করে শরীয়ত বিরোধী কোন অনুষ্ঠান করিও না।” ইসলামের এ অতন্দ্র প্রহরী হাজারো ভক্ত মুরিদান রেখে ১৮৫৮ ইংরেজীর পহেলা নভেম্বর, ২৪ই রবিউল আউয়াল, ১২৭৫ হিজরীর, ১২৬৬ বাংলার ১৩ই কার্তিক শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিয়ুন। তিনি চিরকুমার ছিলেন আজীবন। শিক্ষকতা, ধর্মপ্রচার ও যুদ্ধে পুরা জীবন কাটিয়ে দেন। পীর শহীদ আহমদ বেরলভী তাঁর জন্য দোয়া করেছিলেন এভাবে, “হে আল্লাহ! আপনি নূর মুহাম্মদ’র পরকালের ঘরকে (কবরকে) খুশবুতে ভরপুরে রাখুন।” অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, নিজামপুরী (রহ.)’র মাজারে আজো খুশবু মাখা ঐশ^রিক সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। এ মহান অলিয়ে কামেল আজ শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রামের মীরসরাই মিঠানালা ইউনিয়নে। হে আল্লাহ! আপনার নেয়ামতপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পথে ও মতে জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন।
One thought on “সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.)’র জীবন ও অবদান”
Comments are closed.