নাজিম উদ্দিন: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ মাঝখানে ৫২ বছর। এ যেন হাঁটি হাঁটি পা পা করে গৌরবে সৌরভে প্রস্ফুটিত এক পুষ্পমাল্য। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমার প্রিয় জন্মভূমি।এ অর্জন এ বিজয়ী পতাকার।লাল সবুজের এ পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয় ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ডাকসু’র তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আ স ম আবদুর রব কর্তৃক প্রথম উত্তোলিত হয়। এ যেন বিজয় সংগ্রামের দীর্ঘ যাত্রার পথে প্রথম পদক্ষেপ।জন্মলগ্ন থেকেই একের পর এক বিস্ময় দেখিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ নস্যাৎ করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচার ধর্ষণ ও গণহত্যা চালায়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেন। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ‘নিজের যা আছে, তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলার মুক্তিসেনারা।দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান উৎসাহ এ পতাকা। জীবন বাজি রেখে, জীবন উৎসর্গ করে বাংলাদেশের এ স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে, বৈষম্যের মাঝে, অসম শক্তির সাথে লড়াই করে বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে চূড়ান্ত বিজয় এনে দিয়েছেন, দিয়েছেন সার্বভৌম জাতি। এ যেন সারাবিশ্বকে জানান দিয়ে জন্ম নিলো শিশু বাংলাদেশ, সুতীব্র চিৎকারে..সুকান্তের ভাষায়,”এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;..”হ্যাঁ, পরবর্তী ৫০ বছর এ দেশ পরিপূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করেছে, সম্মানের সাথে বিশ্বের দরবারে দখল করে নিয়েছে তার স্থান।স্বাধীনতা লাভের মুহুর্তে বাংলাদেশ ছিল এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার তো বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেন।বেশ কয়েক বছর দেখি ব্যাপক দারিদ্র্য ও বঞ্চনার চিত্র। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলছিল, তখন খাদ্যসহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার। অর্থনৈতিক অবস্থার এ তলানি থেকে ধীরে ধীরে প্রভূত সফলতা অর্জন করে জন্য বাংলাদেশ।এ দীর্ঘ যাত্রায় ছিলো রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা, ১৫ আগষ্টের কালো রাতের দৃশ্য, সেনা অভ্যত্থান, সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নিপীড়ন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রচলন, সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্টা, বিরোধীদলের উপর নির্যাতন ইত্যাদি দৃশ্যও। ছিলো ধর্মীয় উসকানি ও রাহাজানিও।স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়, উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন বিস্ময়করভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিগুলোর একটি।কৃষির পাশাপাশি শিল্পোন্নয়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল বৃদ্ধি, বিদ্যুত ও জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামীণ অর্থনীতির উত্তরণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যমুনাসেতু, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ হাতে নেয়ার সক্ষমতা অর্জন ইত্যাদি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের কিছু প্রেরণাব্যঞ্জক চিত্র।বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপির হারে পাকিস্তানকে বেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন নেতৃত্বের আসনে রয়েছে। ওষুধশিল্পেও সমৃদ্ধিশালী হয়ে বৈশ্বিক বাজারেও ওষুধ রপ্তানি করছে। কৃষককুল, গগার্মেন্টস শ্রমিক ও রেমিটেন্স যোদ্ধারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তৈরি করেছে এ সুদৃঢ় অর্থনীতির স্তম্ভ।জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপদের আশঙ্কার মাঝেও বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পূর্বের তুলনায় বেশ সক্ষমতা অর্জনে সমর্থ হয়।গড় আয়ু ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি, শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম এবং পুষ্টিহীনতা রোধের মতো সামগ্রিক উন্নয়নে বাংলাদেশের সূচক অতিমাত্রায় না হলেও অনেকগুণে উন্নীত ও দৃশ্যমান। তলাবিহীন ঝুড়ির বদনাম ঘুচিয়ে প্রায় অর্ধ শত বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের দেশ বাংলাদেশ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ট রাষ্ট্রপরিচালনা দেশ সর্বক্ষেত্রে বহুদূর এগিয়েছে, যা আমাদের করে আশান্বিত, স্বপ্নবাজ।তবে মানুষের গড় আয়ু, মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান যতটা বেড়েছে, সে অনুযায়ী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো ততটা উৎকর্ষের পৌঁছাতে পারেনি ৫২ বছরেও। বিগত কয়েক দশকে উপমহাদেশের অন্যান্য বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশসমূহের মতো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, বেকারত্ব, স্বজনপ্রীতি, সড়ক দুর্ঘটনা, জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতে অনিয়ম, শিক্ষাখাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ নীতি ও প্রয়োগের অক্ষমতা, স্বাস্থ্যখাতে কিছু দৃশ্যমান অনিয়ম, অর্থপাচার, রাজনৈতিক দখলদারিত্ব, ধর্মীয় সহিংসতা ইত্যাদি নেতিবাচকতা পরিপূর্ণভাবে দূরীকরণে কাজ করার সময় এসেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকারী যৌবনে পদার্পণ করা স্বাধীন বাংলাদেশের সামনে।শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, জ্বালানি ইত্যাদি খাতে গুরুত্ব দিয়ে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা, কৃষি ও শিল্পখাতে সহায়তা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি নিশ্চিত করতে পারলে আগামি দশকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর একটা।আমরা আশার বীজ বুনি সবসময়। সব অমানিশার বুক ছিড়ে সারা বিশ্বকে অবাক করে বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে আসীন হবে ৫৫ হাজার বর্গমাইলের প্রিয় এ মাতৃভূমি। কবি সুকান্তের ভাষায় বলা যায়,”সাবাস বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।”যুগে যুগে শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনার শিকার বাঙালি জাতি প্রতিবারই ছিনিয়ে এনেছে শ্রেষ্টত্ব। সৃষ্টি করেছে ইতিহাস।একটি বাংলাদেশ, তুমি জাগ্রত জনতার সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার।
লেখক :মোঃ নাজিম উদ্দিন,সহ সভাপতি,
রাউজান সাহিত্য পরিষদ।