মহিউদ্দিন ইমন: বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের স্মৃতিবিজড়িত এবং পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার বিজয়ের দিন ১৬ই ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির আত্মগৌরবের দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারের অধীনে পরিচালিত দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব-মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় বীর শহিদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে জাতি। আমরা গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের; যেসব নারী ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তাদেরও। এ দেশের মানুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কোটি কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন একই লক্ষ্যে অবিচল একদল রাজনৈতিক নেতা। শহিদ জাতীয় চারনেতাসহ তাদের সবাইকেই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে জাতি। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত চরমপত্রের জনক সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল লিখেছিলেন “আমি বিজয় দেখেছি”। আমাদের অনেকেরই দুর্ভাগ্য হয়তো, আমরা বিজয় দেখিনি। যুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মই এখন জনসংখ্যার বড়ো অংশ। ৫২ বছর মোটেই কম সময় নয়, দীর্ঘ সময়ই বলা চলে। তাই আমাদের ইতিহাস পড়ে, জেনে, বুঝে বিজয় অনুভব করতে হয়। ইতিহাস আমাদের যা শেখায় তাই শিখি, কেন কখন কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ এদেশে আবশ্যম্ভাবী হয়ে গিয়েছিল তার সত্য-মিথ্যা কিছুটা আমরা জানি, অনেক সত্যই জানি না, অনেককে জানার কোনো চেষ্টাও করতে দেখি না। জাতির জনকের সপরিবারে নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ইতিহাস পাল্টে ফেলা হয়। একটা প্রজন্ম দীর্ঘদিন সেই ভুল ইতিহাস পড়েই বড়ো হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত আকাঙ্ক্ষার তাৎপর্য অনুধাবন তাই জরুরি বিবেচনা করি। কারণ মুক্তিযুদ্ধ জড়িয়ে আছে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে। এটি আমাদের আগামীর দিকে ধাবিত হওয়ার স্বপ্নও দেখায়। যে আকাক্সক্ষা নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২ বছর পেরিয়ে তার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারলাম আমরা? আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটা বেশ বড়ো ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একটা অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষা ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক মুক্তি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির সংজ্ঞা নিয়ে নানা ধরনের তর্কবিতর্ক হতে পারে, কিন্তু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একটি শোষণহীন সমাজ, জনগণের রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক প্রগতি ও উন্নতির কথা বলেছে। সামাজিক যে বৈষম্যগুলো বিদ্যমান, সেগুলো দূর করাও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল। সমাজ গবেষকগণ তাই মনে করেন, এই ৫২ বছরে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক- অনেক দিক থেকেই আমরা হয়তো এগিয়েছি, কিন্তু সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের যে অন্তর্নিহিত আকাঙ্ক্ষা, সেটির পূর্ণ বাস্তবায়ন থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে থেকে গেছি। বিশেষ করে, রাষ্ট্রের মৌলভিত্তি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বৈষম্যহীন সমাজ অর্থাৎ যেখানে জনগণ অর্থনৈতিক উন্নতির সমগ্র সুফল পাবেন এবং জনগণের রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে জবাবদিহি থাকবে- এই বিষয়গুলো এখনো অনেকটাই অপূর্ণ থেকে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্ক্ষা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল- এখন প্রয়োজন সেগুলো আমরা কীভাবে বাস্তবায়িত করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের পরের প্রজন্ম এই লক্ষ্যগুলো পূরণে কী কী কাজ করতে পারে।আজকের সমাজে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করলে এ কথা বলতেই হবে যে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার মাধ্যমেই কেবল সেটি বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিবর্তনের জন্য তাই এই মুক্তিযুদ্ধ চর্চার বিকল্প নেই। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন মহান বিজয় দিবস। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫শে মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ শহিদ ও দু’লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ফসল আমাদের স্বাধীনতা। সেই সাথে নব নব প্রত্যাশার নানা দিগন্তও উন্মোচিত হয় সমাজ-রাষ্ট্রে।বিজয় দিবসের এই দিনে বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক সামরিক বিজয় অর্জন করে।সবাই কে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
লেখক মহিউদ্দিন ইমন, সভাপতি, রাউজান সাহিত্য পরিষদ।